চা একটা এক ওয়ার্ডের শব্দ হলেও ভারত কোনো সারা বিশ্বে এই গুরুত্ব অপরিসীম। বড়ো শহর থেকে গ্রাম, ভিড় রাস্তা থেকে ছোট গলি চা এর বিকল্প খুঁজে পাওয়া দায়। চা এর দোকান পাওয়া যায় না এমন কোনো জায়গা হয়তো নেই। ট্রেন , বাস যে কোনো যানবাহন থেকে শুরু করে যে কোনো জায়গায় চা এর বিচরণ অবাধ।আর চা ছোট্ট শব্দ হলেও এর প্রকারভেদ প্রচুর , কেউ দুধ চা খেতে ভালোবাসেন তো কেউ শুধু লিকার, আর চিনির পরিমানের তারতম্য তো লেগেই আছে।
কত রকম চা সারাদিনে তৈরী করা যায় একজন চা এর দোকানের বিক্রেতা এই ব্যাপারটা খুব ভালো করে বোঝেন। তবে যেহেতু চা খেলে ক্ষতির পরিমাণ হয় না তাই দীর্ঘদিন সবাই চা খেতে পারে ,মহিলা পুরুষ নির্বিশেষে চা প্রেমী নয় এমন মানুষ হয়তো খুঁজতে হবে।অনেক মানুষ আছেন যারা শুধু চায়ের ওপর নির্ভর করে সারাদিন আর কিছু না খেয়ে কাটিয়ে দিতে পারেন। তাই একথা চোখ বুজে বলা যেতে পারে চা ব্যাবসার থেকে ভালো কিছু হতে পারে না। আর তুমি যদি চা ভালো তৈরী করতে পারো তবে তো দ্বিমত থাকার কোনো কথাই নেই। যেহেতু চা তৈরী করার জন্যে খুব বেশি মূলধন, সাজসরঞ্জাম বা জায়গা লাগে না অনেকেই ভারতবর্ষের মতো জায়গায় চা এর দোকান করেন কারণ এই দেশে চা একটা প্যাশন হিসাবে কাজ করে।শুধুমাত্র চা এর দোকান থেকেই এক একজন ব্যাক্তি কয়েকলাখ টাকা ইনকাম করতে পারেন। চা এর গুরুত্ব এতটাই অপরিসীম। তুমি প্রথমে তোমার জায়গার মধ্যে পাইকারি দামের চায়ের দোকানগুলোয় যাও, সেখানে কে কোন দামে সেগুলো বিক্রি করছে, ঠিকভাবে ডেলিভারি দিতে পারবে কিনা, কোন মানের চা কতটা কিনলে তোমার ব্যাবসার জন্যে সুবিধা হবে সব ব্যাপারগুলো নিয়ে আগে একটু জেনে নাও। এতে করে কোন দোকান থেকে জিনিস কিনলে তুমি তুলনামূলক কম দামে জিনিস পাবে, তোমার লাভের পরিমান বেশি হবে। তোমাকে কয়েকটা ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
ব্যবসা শুরুর জন্য যখন পাইকারি চা পাতা কিনবে, তখন কষ, লিকার, গন্ধ এসব তোমাকে দেখতে হবে। ব্যবসা দাঁড় করার জন্যে প্রথমেই বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। আর তার জন্যে ব্যবসার শুরুতেই পণ্যের মান ভালো রাখতে হবে। ক্রেতা যেমন পছন্দ করবে তেমন তাকে চা অফার করতে হবে। একটাও ক্রেতা হারালে ক্ষতির সম্ভবনা হতে পারে তাই প্রথম থেকে ক্রেতার পছন্দ অপছন্দের দিকে বিশেষ নজর হবে। প্রথম দিকে বেশি লাভ করবো এই মনোভাব নিয়ে চললে চলবে না, বরং আস্তে আস্তে যখন দোকান একটু দাঁড়িয়ে যাবে তখন সেখান থেকে তোমার লাভ নিয়ে চিন্তা থাকবে না। খোলা চা পাতা অথবা হোক প্যাকেট চা পাতা প্রথমের কম দাম ই তোমাকে অন্যদের থেকে আলাদা করবে। চায়ের রং দেখে তার প্রতি অনেকেই আকর্ষিত হই। আর লিকারের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা বেশি দেখা যায়। যেমন তার স্বাদ চাই তেমন ফ্লেভার এর ওপর চায়ের গুণমান ঠিক হয়। লিকার, রং ও স্বাদ এই তিনটিই হচ্ছে চায়ের ব্যাবসার মূল কাঠি। এসব বিষয়ে তোমার যথেষ্ট জ্ঞান নিয়ে তবেই চায়ের ব্যাবসায়ে লেগে থাকতে হবে। চা এর আরেকটা দরকারি পার্ট হলো দুধ। আর ঘন দুধ চা খাওয়ার জন্যে অনেক মানুষই বেশ আকুল। কোথা থেকে দুধ কিনলে সঠিক মানের পরিমান মতো দুধ পাওয়া যায় সেটাও দেখার একটা অন্যতম দিক।তুমি হয়তো সময় পেলে না সেক্ষেত্রে যার কাছ থেকে দুধ কিনবে তাকে বলতে পারো তোমার দোকানে এসে পৌঁছে দেয়ার জন্যে। এতে তোমার সময়ও কিছুটা বেঁচে যাবে।
প্যাশনের পাশাপাশি চা ভারতীয়দের কাছে একটা নেশা। কথা বলার সঙ্গী , বা মাথা ব্যাথার ওষুধ চা অনেকক্ষেত্রেই উপশমের কাজ করে। আন্তর্জাতিক ভাবেও চা এর অবদান অস্বীকার্য। কত বড়ো বড়ো দোকান শুধু চা খাওয়ার জন্যেই তৈরী হয়েছে। এক্ষেত্রে বলি সবজায়গাতেই চা এর দোকান ভালোই চলে।তবে যেখানে অফিসিয়াল কাজকর্ম কম হয়, সাধারণ মানুষের বাস বেশি এমন জায়গা দোকান দেয়াই ভালো। চা এর দোকান মানেই সেখানে কিছু লোক আসবে, এসে টাইম স্পেন্ড করবে, এর জন্যে তুমি মাথা গরম করলে চলবে না। বসবাসযোগ্য কিন্তু এমন জায়গায় দোকান করা উচিত যেখানে সব রকম সুবিধা আছে। আরো একটা বিষয়ে তোমাকে দেখতে হবে। অনেকেই ব্যাস্ততার জন্যে দোকানে এসে হয়তো চা খেতে পারছে না, এক্ষেত্রে তোমাকে চা ডেলিভারি দিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে হবে। তুমি যদি নিজে টাইম ম্যানেজমেন্ট করতে পারো তাহলে তো খুবই ভালো , নাহলে কাউকে রেখে সেই ব্যবস্থা করাতে পারো, যখন তুমি দোকানে থাকবে না সে যাতে ব্যবস্থা করতে পারে। যেকোনো ব্যবসাতেই অলসতার কোনো জায়গা নেই , একদিন দোকান খুললে, ৩ দিন খুললে না এভাবে দোকানের ক্রেতার উপর প্রভাব ফেলবে, ফলে তারা তোমার দোকান ছেড়ে পাশের দোকানে চলে যাবে। আর সময়ের ওপর ভীষণভাবে সতর্ক হতে হবে।
অনেকেই ভোরবেলা বাড়ি থেকে কাজের প্রয়োজনে বেরিয়ে পরেন, হয়তো সকালে সে ভাবলো তোমার দোকান থেকে চা খাবে, কিন্তু সে যদি দেখে তোমার দোকান সেদিন বন্ধ সেটা একটি আশাহীন ব্যাপার ই হবে। তাই প্রতিদিন ঠিক সময়ে তোমার দোকান খুলতে হবে এবং বন্ধ করতে হবে। চা খাওয়ার জন্যে অনেকে ভাঁড়ের খোঁজ করেন। এই স্পেশাল গন্ধের জন্যে অনেকেই বার বার মাটির ভাঁড়ে চা খেতে চান। আবার অনেকের কম চায়ে প্রয়োজন মেটে না। তার বেশি পরিমাণে চা চাই। তাই যেমন ভাঁড় এর কালেকশন দোকানে রাখতে হবে, তেমনি ছোট বড়ো বিভিন্ন রকম কাপ, গ্লাস ও রাখতে হবে তবেই একটা দোকান সঠিকভাবে সেজে উঠবে। ধরুন আপনি ১ কেজি পাতি কিনলেন ৩৫০ টাকা দিয়ে যা দ্বারা আপনি মিনিমাম ৩০০ কাপ চা বানাতে পারবেন তাহলে ৩০০৫ ১৫০০ টাকার চা বিক্রি করতে পারবেন। আপনি যদি জ্বালানি বাবদ আরো ১০০ টাকাও ধরেন তাহলে ৪৫০ কি ৫০০ টাকা খরচ করে ১৫০০ টাকা আয় করতে পারবেন। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা ভাবনা সুধু দোকান করলে হবে না পজিশন ও খুজতে হবে। একটু কষ্ট হলেও ভালো পজিশন মোতাবেক দোকান করতে হবে।
আমি কিছু পজিশন তুলে ধরছি। বাসস্ট্যান্ড, কোটের আসেপাশে, বাজারের পাশে, ভূমি অফিসের পাশে, কলেজের পাশে, মেডিকেলের পাশে, থানার পাশে, সরকারি অফিস আদালতের পাশে, ব্যাংকের সাথে, কোন পর্যটন এর সাথে এসব যায়গায় চায়ের দোকান দেওয়া মানে রাতারাতি বড়লোক হওয়া সমান কথা। মানুষ প্রতিদিন চা পান করে। তাই চায়ের স্বাদ এবং মানের উপর অনেককিছু নির্ভর করবে। স্বাদ বাড়াতে চায়ের অতিরিক্ত কিছু যোগ করা যায়। অভিনবত্ব আনা যায় পরিবেশনে। চা বিক্রেতার নাম ওমর ফারুক। নিউমার্কেটের একাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মধ্যবয়সী ওমর ফারুক ৮-১০ বছর ধরে এই মার্কেটে খাবার বিক্রির কাজ করেন। এক সময় মাত্র একশ টাকা বেতনে চাকরি করলেও পরবর্তীতে যে মালিকের অধীনে চাকরি করতেন সেই মালিকের কাছ থেকেই চায়ের দোকানটি কিনে নেন। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তার চায়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। ওমর ফারুকের সহকর্মী এক তরুণ জানান, কাকডাকা ভোর থেকে দুই কর্মচারী চায়ের দোকান খোলার প্রস্তুতি শুরু করেন। সকাল ৯টা থেকে চা বিক্রি শুরু হয়ে রাত ৯টা পর্যন্ত চলে। প্রতি কাপ চায়ের মূল্য ১০ টাকা। গড়ে প্রতিদিন প্রায় এক হাজার কাপ চা বিক্রি হয়। এ হিসেবে মাসে গড়ে প্রায় তিন লাখ টাকার চা বিক্রি হয়। তবে শুক্রবার ও ছুটির দিনে ১২শ’ থেকে ১৩শ’ কাপ চা বিক্রি হয়।
নিউমার্কেটের দোকান মালিক ও কর্মচারীরা দোকানে বসেই ওমর ফারুকের চা খেয়ে কাজে মনোযোগ দেন। মতিউর রহমান নামে নিউমার্কেটের এক ব্যবসায়ী বলেন, এক সময় যারা নিউমার্কেটে নিয়মিত আড্ডা মারতেন ও বর্তমানে বিভিন্ন পেশায় আছেন তাদের অনেকেই এখনও এদিকে এলে ওমর ফারুকের হাতে বানানো এক কাপ চা না খেয়ে যান না। রমজান মাসে ইফতারের পর দোকানে খুব ভিড় হয়। অনেক সময় এক কাপ চায়ের জন্য আধাঘণ্টাও অপেক্ষা করতে হয়। তবে ওমর ফারুক নিজের সম্পর্কে খুব বেশি কিছু বলতে নারাজ। আলাপকালে তিনি জানান, এক সময় অনেক কষ্ট করছি। অহন সুখের লাগাল পাইছি।
শেষ কথা:
চায়ের দোকান ব্যবসা সহজলভ্য হলেও এর গুরুত্ব এবং সম্ভাবনা বিশাল। এটি কম পুঁজিতে শুরু করা যায়, এবং প্রতিদিন প্রচুর ক্রেতা আকর্ষণ করতে সক্ষম। সঠিক পরিকল্পনা, গুণগত মান, এবং সেবা প্রদানের প্রতি যত্নবান হলে একজন ব্যবসায়ী এই খাত থেকে ভালো আয়ের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদী সফলতাও অর্জন করতে পারেন। চায়ের প্রতি মানুষের ভালোবাসা ও এর চাহিদার নিরন্তর ধারা বিবেচনায়, চায়ের দোকান শুধু আয়ের উৎস নয় বরং একটি সমৃদ্ধ ব্যবসায়িক সম্ভাবনার ক্ষেত্র হিসেবেও পরিচিত।